Skip to main content

কোচবিহার রামভোলা স্কুলের স্মৃতিচারণা

-- কোচবিহার রামভোলা স্কুলের স্মৃতিচারণা --

রাজ্যস্তরে   সম্মানিত    শিক্ষকররত্ন  শিবাশিস মজুমদার অনুরোধ করেছেন কোচবিহার রামভোলা স্কুলের ছাত্র শিক্ষক সম্প্রীতি সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিগত দিনের কিছু তথ্য সর্বসমক্ষে তুলে ধরতে । এরই মধ্যে দেখছি আমার কর্মস্থল হিন্দুস্তান কেবলস হাই স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের প্রিয় স্কুল নিয়ে স্মৃতিচারণা করছে । তখনই জাড্যতা ঝেড়ে ফেলে লিখতে শুরু করি এবং দেখছি একাজে আমি নিজেও আনন্দ পাচ্ছি ।

আমাদের স্কুলের অবস্থান রাজপ্রাসাদ থেকে অল্প দূরে । স্কুলের উল্টোদিক গুঞ্জবাড়ির বড়দীঘি । ওখানেই  মদনমোহন (জগন্নাথ) ঠাকুরের মাসীর বাড়ি।স্কুলের পশ্চিমে তোর্সা নদীর বাঁধ । আমি রামভোলা স্কুলে ঢুকেছিলাম ১৯৫৯ সালে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে । ৬৩ তে টেস্ট ও ফাইন্যাল পরীক্ষা ৬৪ সালে । অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগের স্মৃতি ভাণ্ডারের ডালা খোলা হচ্ছে ! সেই সময় রামভোলা স্কুলের  ক্লাসরুমে পাখা ছিল না । সাহেবের মতো সাদা রঙের অধিকারী নলিনী বোস স্যার গরমে কাতর হয়ে তালপাতার পাখা ধরেছিলেন । ক্লাসে পায়চারি করতে করতে হাওয়া খেতেন এবং হাস্যরস সহকারে মধ্যযুগের ইতিহাস পড়াতেন ।
একদিন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ,  বলতো খলিফা মানে কি ?  আমি মহা উত্সাহে জবাব দিলাম ,  দরজী স্যার !
স্যার বললেন ,  হ্যাঁ দরজী মানেও ঠিক বটে তবে এখানে শব্দটা মুসলমান ধর্মীয় নেতাকে বোঝাচ্ছে  ।
লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেল ।
তখনকার দিনে শিক্ষকরা প্রায় প্যান্ট শার্ট পরতেন না । ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি বা শার্ট পরা শিক্ষকগণ বাংলার বিশিষ্ট ভদ্রমন্ডলির প্রতিনিধিত্ব করতেন ।

                                 আমাদের খেলার শিক্ষক ছিলেন দিনেশ রায় । তাঁর তৈরি ফুটবল টিম   ইন্টারস্কুল প্রতিযোগিতায়  অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল । সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল রক্ষণ বিভাগ । চিনের পাঁচিলের মতো দুর্ভেদ্য ।   কিছু ফুটবলার সম্পর্কে একটা জনশ্রুতি ছিল । তারা নাকি স্কুলকে ভালবেসে প্রতি ক্লাসে এক দু বছর জিরেন দিয়ে প্রমোশন নিত ! ক্রিকেট খেলাতেও তারা কম যেত না । একবার আমাদের স্কুল মালবাজার না কি একটা টি এস্টেটের স্কুলে ক্রিকেট দল নিয়ে গিয়েছিল । আমাদের বন্ধু প্রশান্ত ভট্টাচার্য এখনকার টি টোয়েন্টির কায়দায় এমন ছক্কা হাঁকিয়েছিল যে বল আর খুঁজে পাওয়া যায় নি ! বাৎসরিক স্পোর্টস -এর সময় স্কুলের চেহারা পাল্টে যেত । সারা দিন ধরে উৎসবের মেজাজ । স্পোর্ট্স ইভেন্ট মোটামুটিভাবে কমন হলেও দুই একটি ক্ষেত্রে আমাদের স্কুল ব্যতিক্রম ছিল । সেটি হচ্ছে স্লো সাইকেল রেস , আর পোল ভল্ট । এই আইটেম দুটো আমি অন্য কোথাও দেখিনি । দিনেশ স্যারের বাংলা ক্লাসে শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতি ছিল  অদ্ভুত ।তিনি ডাস্টারের কাঠের ওপর উল্টো করে পড়া না পারা ছেলের ললাটলিপি লিখতেন চক দিয়ে । তারপর কপালে ছাপ  মারার পর কেউ হয়ে যেত গাধা , গর্দভ - কেউবা গরু ছাগল ! শাস্তিপ্রাপ্ত ছেলেটি কিছু বুঝতে পারতো না অথচ গোটা ক্লাস হেসে গড়াগড়ি যেত !
বছরে আর এক দিন স্কুলের গরিবানার লক্ষণ মুছে যেত । সেটা হচ্ছে বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী উৎসব । ছাত্রদের ভেতর থেকে বেছে নিয়ে সুরসাধক সুনীল রায় অনেক ঘষেমেজে একদল কোরাস ও সোলো গায়ক তৈরি করতেন । একবার একটা অভিনব উপস্থাপনা হয়েছিল । স্টেজের এক পাশে একটি ব্ল্যাকবোর্ড দাঁড় করানো আছে । গায়ক গান ধরেছে । গানের কথায় গাছ ফুল পাখি মেঘ - এমনকি বৃষ্টির ধারাও আছে । গানের সাথে সাথে একজন শিল্পী ছাত্র চক হাতে নিয়ে বোর্ডে ফটাফট দৃশ্যপট ফুটিয়ে তুলছে । আইটেমটা খুব আকর্ষণীয় হয়েছিল ।  কালচারাল অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ নাটক । একবার নলিনী স্যারের নির্দেশনায় অভিনীত The Bishop's Candlesticks খুব প্রশংসিত হয়েছিল ।
আমাদের বিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন ফণীন্দ্রভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় । তিনি একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ,  বল দেখি জলের ধর্ম কি ?
আমি বললাম ,  জলের ধর্মই সমোচ্চশীলতা  । স্যার বলে উঠলেন,  বইটা মুখস্থ করেচিস দেখছি !  খুবঅভিমান হয়েছিল- মুখস্থ করলেও নিন্দা!

নিচু ক্লাসে পড়ার সময়েই বিশাল আকারের H S Building ও Laboratory তৈরি হচ্ছিল ।নাইনে উঠে সেখানে স্থানান্তরিত হলাম । আর্টস- এর ছাত্র হিসেবে নাইন থেকে প্রতিবার প্রথম স্থান অধিকার করে পুরস্কার লাভের সম্মান পাই ।
এবারে বলব বাংলার শিক্ষক অশনিভূষণ মজুমদারের কথা । তাঁর  উজ্জ্বল উপস্থিতি অবিস্মরণীয় । ক্লাসে তাঁকে কখনও পড়াচ্ছেন বলে মনে হত না । মনে হত যেন তিনি হাসিমুখে গল্প করছেন , অথচ আমরা নিত্যই সমৃদ্ধ হয়ে উঠছি  ! তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যর প্রথম সারির লেখক অমিয়ভূষণ মজুমদারের ছোট ভাই । তিনিও সাহিত্য রচনায় পারঙ্গম ছিলেন । কোচবিহার জেলা গ্রন্থাগারে তাঁর ছোট গল্পের সংকলন দেখেছি । সত্যিকারের ভালবাসা কেমন বোঝাবার জন্য একদিন তিনি কিং লিয়ারের কাহিনি শোনালেন । বড় দুই মেয়ের চাটুকারিতায় ভরা কৃত্রিম ভালবাসার কথায় মোহিত হলেন । অন্যদিকে ছোট মেয়ের বিশেষণ বর্জিত সাদামাটা কথা বাবাকে রুষ্ট করল । অল্পদিনের মধ্যেই অবশ্য তাঁর মোহভঙ্গ হল । তাদের স্বার্থপরতায় সর্ব:স্বান্ত হয়ে ফিরে আসেন ছোট মেয়ের কাছেই প্রকৃত ভালবাসার মর্ম বুঝে । এরপর হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করলেন,  বল দেখি , মা ও বৌ - এই দুজনের মধ্যে কার ভালবাসা কেমন ? নিজেই কৌতুক করে বললেন,  দিনের শেষে খেটেখুটে ছেলে ঘরে ফিরলে মা তাকান তার শুখনো মুখের দিকে । আর বৌ তাকায় ট্যাঁকের দিকে ,মাইনে কিম্বা উপরি কিছু নিয়ে সে ফিরেছে কিনা  দেখতে ! 
আর একদিন ক্লাসে বললেন, অনুমান কর দেখি, ঘরে আগুন লাগার খবর পেলে  বা ভূমিকম্প হলে কি কি নিয়ে আমি পালাব ? এই উদ্ভট প্রশ্ন শুনে আমরা তো হাঁ হয়ে গেছি । পরক্ষণেই মিষ্টি হেসে বললেন,  আমার একদিকে বগলদাবা থাকবে রবীন্দ্রনাথের কিছু প্রিয় বই , অন্য ধারে বৈষ্ণব পদাবলী । এই সম্পত্তি নিয়ে আমি ঝাঁপ দেবো দোতালার বারান্দা থেকে !

আমরা একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় এই প্রিয় শিক্ষক মহাশয় আলিপুরদুয়ার হাই স্কুলে হেডমাস্টারের পদ নিয়ে  চলে যান  । স্যারের সেই স্কুলে একদিন আমাদের পাড়ার গোপেশদার সঙ্গে একটি লেখা আনতে গিয়েছিলাম । গোপেশ দত্ত ছিলেন রণজিৎ দেবের বন্ধু এবং ত্রিবৃত্ত সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত । আমাদের দেখে স্যার খুব খুশি হলেন । সঙ্গে নিয়ে তিনি তাঁর নব নির্মিত বিদ্যালয় ভবন দেখালেন ।একটু বসতে বলে জরুরি কিছু কাজ করে আমাদের দুজনকে বাড়ি নিয়ে এলেন । খবর মনে হয় পাঠানো ছিল । ঠাকুর রান্না করে রেখেছে । পেট পুরে খাইয়ে , লেখা গোপেশদার হাতে দিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন । সে দেখাই শেষ দেখা । বেশ কিছুদিন পর তাঁর অকাল মৃত্যুর খবর পেয়ে শোকবিহ্বল হয়েছিলাম ।

বাংলার শিক্ষক হিসেবে আমরা বেশি করে পেয়েছিলাম উষা কুমার দাস মহাশয়কে । তিনি জেনকিন্স স্কুল থেকে অবসর নিয়ে রামভোলাতে আসেন। ইনি হচ্ছেন সেই খ্যাতনামা শিক্ষক যাঁর নামে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুবোধ চক্রবর্তী তাঁর রম্যাণি বীক্ষের প্রথম পর্ব উৎসর্গ করেছিলেন ।আমরা সৌভাগ্যবান , তাঁর মতো অসাধারণ শিক্ষকের সাহচর্য পেয়েছিলাম ।

হায়ার সেকেন্ডারিতে ভূগোল পডাতেন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী স্যার । ইনিও জেনকিন্স স্কুল থেকে আগত অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক । ভূগোল আমার খুবই প্রিয় বিষয় ছিল । ইংরেজি স্যারের অনুপস্হিতিতে ক্লাসে এলে তিনি বাংলা প্যাসেজ বেছে ইংরেজি করতে দিতেন । ঐ প্যাসেজগুলোর অধিকাংশ বাংলা ক্ল্যাসিকস থেকে নির্বাচিত । তিনি জানতে চাইতেন , ঐ অংশটা কোন্ গল্প থেকে নেওয়া । প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমি সঠিক উত্তর দিতে পারতাম, কারণ আমি থাকতাম দিদির বাড়িতে । সেখানে প্রচুর সাহিত্যের বই ছিল । তিনি সকলকে বাইরের ভাল বই পড়ার উৎসাহ দিতেন । তিনিই প্রথম ইংরেজি উচ্চারণের ব্যাপারে আমাদেরকে সজাগ করেছিলেন । বাংলা স্পর্শবর্ণ উচ্চারণের সময় অধোরষ্ঠ পরস্পরকে স্পর্শ করে । কিন্তু ইংরেজি p বা f উচ্চারণের সময় অনেক ক্ষেত্রেই অধর ও ওষ্ঠের মধ্যে ফাঁক থাকে । সেটা তিনি উদাহরণ দিয়ে বোঝাতেন । অনেক ইংরেজি শব্দের শেষ অংশটা প্রায় শোনাই যায় না, বিশেষ করে  r  থাকলে । এর ভেতরের রহস্য হচ্ছে  stress & intonation. এটাও তিনিই প্রথম ধরিয়ে দেন । পরে অবশ্য phonetics নিয়ে বিশদ ভাবে জানার সুযোগ মেলে কলেজে স্বনামধন্য অধ্যাপক শশিভূষণ দাস স্যারের সান্নিধ্যে এসে । তিনি literature এবং language- দুটোতেই এম এ ছিলেন । আমার সৌভাগ্য , এ ব্যাপারে আমি আরও সমৃদ্ধ হয়েছিলাম সুধীশ কুমার মজুমদার মহাশয়ের স্নেহচ্ছায়ায় এসে । ইংরেজির ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য পাণ্ডিত্যের কথা কোচবিহারের বিদগ্ধ পরিমণ্ডলে সুবিদিত । তিনিও এই স্কুলে কিছুকাল কাজ করেছেন ।
অষ্টম শ্রেণীতে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম যতীন্দ্র মোহন চৌধূরী মহশয়কে । তাঁর প্রণীত ইংরেজি গ্রামার ট্র্যান্সলেশন বই আমাদের পাঠ্য ছিল । ভিতটা তিনিই তৈরি করে দেন ।
ইংরেজি কম্পোজিশনের অজস্র ভুল ত্রুটি যিনি অম্লান বদনে শুদ্ধ করে দিতেন তিনি ছিলেন অধীর সরকার মহাশয় । তাঁর  নি:শব্দ অবদানের   পরিমাণ অপরিমেয় ।
ইংরেজি গ্রামার শেখানোর কাজে অসামান্য নৈপুণ্যের অধিকারী ছিলেন সুরেন কর মহাশয় । একদিন কি একটা প্রসঙ্গে তিনি বলেন , এখানে ( কোচবিহারে ) ছেলেদের কোন ভবিষ্যৎ নেই । টাকা উড়ছে খনি ও শিল্পাঞ্চলে । ভাগ্যের ফেরে এই শিল্পাঞ্চলেই আমার চাকরি জীবনের সিংহভাগ কাটাই এবং স্যারের কথার সত্যতা উপলব্ধি করি । চিত্তরঞ্জন , রূপনারায়ণপুর , আসানসোল , রানিগঞ্জ , দুর্গাপুর - এসব জায়গায় ডেকে ডেকে চাকরি দেওয়া হত । আর কয়লার খনি অঞ্চলে টাকা সত্যি উড়ত । শুধু খপ করে ধরার অপেক্ষা ! ন্যাশনালাইজেশনের পরও চুরি বন্ধ হয়নি । তবে আমি যেহেতু শিক্ষকতার পেশা নিয়ে এই এলাকায় এসেছিলাম , তাই মাপের বাইরে  কাঞ্চনলাভ  আমার হয়নি  । সেজন্য অবশ্য আফসোসও নেই ।
এবারে  আসি হেডমাস্টার মহাশয় , সুনীল দত্তগুপ্তের প্রসঙ্গে । আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি  তখন তিনি লন্ডন চলে যান এম এড করতে । দুবছর পর যখন এলেন , তখন বেশভূষা পুরোপুরি পরিবর্তিত ! কোথায় ধুতি পাঞ্জাবি - এ যে একেবারে পুরো দস্তুর সাহেব ! মুখে একটিও বাংলা শব্দ নেই ! একাদশ শ্রেণীর বাকি দিনগুলো তিনিই মুখ্যত আমাদের ইংরেজি নিতেন । তাঁরই দৌলতে spoken English মোটামুটি রপ্ত হল ।
তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন ।
একদিন তিনি ক্লাসে বললেন ,  What will you do if you suddenly hit a jackpot , I mean, get huge money in lottery ?  আমরা কয়েকজন ভাল ভাল আদর্শবাদী কথা বললাম । স্কুল ,কলেজ , হসপিটাল ইত্যাদি স্থাপন করার পরিকল্পনা শোনালাম । তিনি ঈষৎ হাস্য করে বললেন , এতে কিছু হবে না । আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নাম শুনেছ ? উনি বাঙ্গালিকে ব্যবসা করতে বলেছেন । ক্যাপিটাল হাতে এলে একটা কিছু উদ্যোগে যদি লেগে যেতে পারো তবে নিজের লাভ।  দেশেরও লাভ । ইংল্যান্ডের যেটুকু ফসল হয় , তাতে ওদের ক'মাস চলে ? দেশ বিদেশে ব্যবসা করেই তো ওরা অত শক্তিশালী হয়েছিল । আমাদের দেশেও লক্ষ্মীদেবী বাঁধা আছেন বাঙ্গালী ভিন্ন অন্য কিছু সম্প্রদায়ের হাতে ! কথাগুলো মনে রেখো । মনে রেখেছিলাম কিন্তু করে উঠতে পারিনি ।
ইতিহাস পড়াতেন হরিদাস মুখার্জি মহাশয় । টেবিলের ওপর আরাম করে বসে তিনি ইতিহাসের কাল, ব্যক্তি ও ঘটনাবলি চাক্ষুষ করাতেন । সঙ্গে থাকত ঝাঁঝালো মন্তব্য । সমকালের প্রসঙ্গও উঠত ।আক্রান্ত হতেন নেহেরুজী। দেশ ডুবিয়ে বিশ্ব শান্তি খোঁজার প্রয়াসকে তিনি তুলোধুনো করতেন । চিনের দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে শিশুসুলভ সরলতা নিয়ে বসে থাকাকে তিনি বলতেন  আহাম্মকি  । তাঁর প্রিয় বাক্যবন্ধ ছিল , নেহেরু- নীতি পঞ্চশীল     দেশকে দিল পঞ্চ কিল ! শোকাহত হয়ে লোকটার অকাল মৃত্যু হল চিনের হাতে ৬২-র পরাজয়ের পর  ।  আরও যাঁরা স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছেন তাঁরা হলেন শ্রদ্ধেয় সুরেন্দ্রনাথ রায় ( সহ / ভারপ্রাপ্তে ) প্রধান শিক্ষক , কবীন্দ্র সমাজদার , ক্ষেত্রমোহন জোয়ারদার ,সুদর্শন চক্রবর্তী, সৌম্যেন ঘোষ , সৌমেন দে , হিমাদ্রি ভট্টাচার্য, দিগিন দেবনাথ , হরিপদ পাল প্রমুখ বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকগণ। শ্রীযুক্ত ঘোষ মহাশয় বিনয় এবং আমাকে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে পড়তে উৎসাহিত করেছিলেন ।

আমাদের সংস্কৃতের  স্যার মাঝে মাঝেই বলতেন ,  তোমরা মহাপুরুষ নাও হতে পারো কিন্তু ভাল মানুষ অবশ্যই হতে পারো । আমাদের প্রার্থনা শেষ লাইন ছিল : অসতো মা সদ্গময় ,/ তমসো মা জ্যোতির্গময় , /
মৃত্যোর্মাহমৃতংগময় , / আবিরাবীর্ম এধি । 

স্মৃতি যে সততই সুখের একথার সত্যতা গভীরভাবে অনুভব করলাম স্মৃতি উদ্ধারের কাজে হাত লাগিয়ে । যাঁরা জ্ঞানাঞ্জন শলাকা দিয়ে শিষ্যের মনের অন্ধকার দূর করেন , সেই পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরুকুলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি । এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্য শিক্ষক শিবাশিস মজুমদারকেও ধন্যবাদ জানাই । একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আশা রাখি এখনকার এবং আগামীদিনের ছাত্ররা স্কুলের ভাবমূর্তি আরও আরও উজ্জ্বল করবে । শিক্ষকগণও শুধু রাজ্যস্তরে নয় , জাতীয়স্তরেও সম্মানিত হয়ে সকলের গর্বের কারণ হবেন ।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধ পূজা

উনবিংশ শতকের মনীষীদের মধ্যে স্বামী বিবেকান্দ ও রবীন্দ্রনাথ গৌতম বুদ্ধের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন । বৌদ্ধ ধর্ম ভারতে প্রায় বিলুপ্ত হলেও বুদ্ধদেব কিন্তু হিন্দু অবতার বরিষ্ঠদের একজন । তাঁর জীবন ও বাণী সর্ব যুগের আদর্শ হতে পারে । সেই মহতী বাণী সমগ্রের সারমর্ম বিধৃত আছে চারটি শব্দের মধ্যে : মৈত্রী , করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা । প্রতিদিনের জীবন যাত্রায় এই চারটি গুণ অনুসৃত হলে মানুষ তার ক্ষুদ্র সত্তা অতিক্রম করে মহাত্ম্যা হবে , পুনর্জন্মের দুর্ভোগ ভুগতে হবে না ।ব্যাপারটা একটু বিশদ করি । আমরা সাধারণ মানুষরা আলাদা আলাদা সংসার পেতে সুখের সন্ধানে মেতে উঠি । এটা চাই , ওটা চাই - চাওয়ার শেষ নেই ! এই যে সর্বগ্রাসী অভিলাষ , এটাই সকল দু:খের মূল । তাই বুদ্ধ বললেন ," কামনা উপেক্ষা কর । হৃদয়ে সদা বহমান হোক মৈত্রী ও করুণা ধারা । সকলকে আপন কর । শুধু মানুষ নয় , মনুষ্যেতর প্রাণীকুলকেও আপন কর । এই অবাধ সেবা ধর্মের আচরণের ফলে মানুষ মহামানব হবে যা দেবত্ব প্রাপ্তির চেয়েও বড ।সেই অবস্থায় এক অনির্বচনীয় প্রশান্তিতে তার মুখমণ্ডল শোভিত হবে । এরই নাম মুদিতা । এই অপার্থিব রূপই পরিলক্ষিত হয়...

শব্দের মন মাতানো ইতিহাস - একিলিস ও হেক্টরের দ্বন্দ্ব

Achelles' heel -এই ইডিয়ামের অর্থ: কারুর শারীরিক বা চারিত্রিক দুর্বলতার জায়গা ।একিলিস ছিলেন অন্যতম প্রধান গ্রিক বীরদের মধ্যে একজন । কিন্তু তার পায়ের গোডালি ছিল খুব দুর্বল । কেন দুর্বল তা জানতে হলে দুর্যোধনের কাহিনি উঠবেই । কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ যখন দ্রুত ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগুচ্ছে-শতপুত্রের মধ্যে অনেকেই নিহত , তখন গান্ধারী প্রিয় পুত্র দুর্যোধনকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখার উপায় ভাবলেন । তিনি পুত্রকে বললেন গোপনে স্নান সেরে নিরাভরণ নিরাবরন দেহে তাঁর সামনে হাজির হতে । গান্ধারী মনে মনে ঠিকক করেছেন তাঁর সাধনা- লব্ধ শক্তি দিয়ে দুর্যোধনের শরীর দুর্ভেদ্য করে দেবেন । শুধু তো একবার চোখ খুলে তাকানোর অপেক্ষা!তাঁর মনের কথা টের পেয়ে শ্রীকৃষ্ণ এক ফাঁকে দুর্যোধনের কানে মন্তর দিলেন: যুবাপুরুষ তুমি ,মায়ের সামনে উলঙ্গ হয়ে দাঁডাবে? লজ্জার মাথা খেয়েছ ? দুর্যোধন তখন একখণ্ড লজ্জানিবারনী বস্ত্র নিম্নাঙ্গে জডিয়ে মায়ের সামনে এল । মা চোখের বাঁধন খুলে তাকানো মাত্র বস্ত্রাবৃত জায়গাটুকু ছাডা দুর্যোধনের বাকি শরীর লৌহ- কঠিন হয়ে গেল । কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে । পরের ঘটনা আমাদের সবার ...

যোগ বিষয়ে ব্যতিক্রমী ভাবনা

২১শে জুন বিশ্ব যোগ দিবস । যোগের মাহাত্ম্য ও ভারতের অবদান নিয়ে এতটাই প্রচার চলছে যে কিছু কথা আপনার আমার কানে ঢুকবেই । এই মূহুর্তে আমার নাতনি সেই বহুশ্রুত গানটা গাইছে - বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো ....." এ গান আমার ছেলেও গেয়েছে তার ছেলেবেলায় । তখন ততটা মনোযোগ দিই নি । আজ আমি তাক থেকে গীতবিতান নামিয়ে গানটা বার করে পড়লাম । আমার তাৎক্ষণিক অনুভূতি আপনাদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি । কালজয়ী কবিরা যেহেতু স্থান কাল পাত্রপাত্রী ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে , তাই আশা করি আপনাদেরও ভাল লাগতে পারে । সকলেই জানেন, যোগের অর্থ - চঞ্চল মনের গতি রোধ করে ধ্যেয় বস্তু বা সত্ত্বার সঙ্গে একীভূত হওয়া । কিন্তু লক্ষ্য করুন, আলোচ্য গানের বিশ্বপিতা নিজেই যুক্ত হচ্ছেন বিশ্বের সাথে ! শাস্ত্রে আছে - ভক্ত ভগবানকে খোঁজে । এখানে ভক্তের কিন্তু আলাদা স্টেটাস বা প্রিভিলেজ নেই । ভগবান সকলকেই আপন করে নিতে নিজে এগিয়ে এসেছেন । কবিও সাধারণের মধ্যে থেকেই ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হতে চাইছেন । দ্বিতীয়ত দেখুন , ধ্যান সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণা হচ্ছে - মনে বনে কোণে - এই তিনটে ধ্যানের উপযুক্ত জায়গা । রবীন্দ্রনাথ বলিষ্ঠ প্...